বুধবার , ১২ মার্চ ২০২৫
Wednesday , 12 March 2025
১২ রমজান ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:৪৫, ৪ মার্চ ২০২৫

যুদ্ধে ইউক্রেনের খরচ কত, কোন দেশ কত দিল

যুদ্ধে ইউক্রেনের খরচ কত, কোন দেশ কত দিল
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুদিন আগেই দাবি করেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য তাঁর দেশ ৩৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। কিন্তু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির হিসাবের ট্রাম্পের দাবি মিলছে না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থাগুলো এবং পশ্চিমা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যের সঙ্গেও তা অসংগতিপূর্ণ।

সাম্প্রতিক সময়ে, ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় এবং দেশটির খনিজ সম্পদে ওয়াশিংটনের প্রবেশাধিকার নিয়ে একটি চুক্তি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু গত শুক্রবার হোয়াইট হাউসে এই চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও ট্রাম্প-জেলনস্কির মধ্যকার বাগ্‌বিতণ্ডার পর তার আর স্বাক্ষরিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে সহায়তা দিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইউক্রেনের খনিজে প্রবেশাধিকার চাইছিল।

আলোচনার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ উন্নয়ন থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রাজস্ব দাবি করেছিল। কিন্তু প্রথম দিকে, ইউক্রেন এতে সম্মত হয়নি। পরে এই দাবি প্রত্যাহার করলে ইউক্রেন চুক্তিতে সম্মত হয়। জেলেনস্কি বলেছেন, এই পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রকৃত সহায়তার পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মতে, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সহায়তা ১০০ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেসের গবেষণা বিভাগের জানুয়ারি মাসের এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, কংগ্রেস গত তিন বছরে ইউক্রেনের জন্য মোট ১৭৫ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করেছে। জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমির হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদিত তহবিলের প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার সরাসরি ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।

কিয়েল ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মধ্যে ৬৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র ও সামরিক সহায়তার জন্য দেওয়া হয়েছে। বাজেট সহায়তা হিসেবে ৪৯ বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে, যা ইউক্রেন সরকারের বেসামরিক কর্মচারী, স্বাস্থ্যকর্মী এবং জরুরি সেবা কর্মীদের বেতন পরিশোধে ব্যবহৃত হয়েছে। আর ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তায় ব্যয় করা হয়েছে।

তবে ১৭৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বড় অংশ সরাসরি ইউক্রেনকে সহায়তা করতে ব্যবহৃত হয়নি। এটি মূলত যুদ্ধ সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য ব্যয় করা হয়েছে, যার মধ্যে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করা, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সহায়তা দেওয়ার মতো খাত অন্তর্ভুক্ত।

কংগ্রেস অনুমোদিত অর্থের একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রেই ব্যয় হয়, যেখানে মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানির কর্মীদের নতুন অস্ত্র তৈরির জন্য বেতন দেওয়া হয়—যেগুলো দিয়ে জাতীয় মজুত পূরণ করা হয় বা ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে প্যাট্রিয়ট ও নাসামস বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, কোটি কোটি গোলাবারুদসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, যা প্রতিরক্ষা শিল্পে রেকর্ড পরিমাণ অর্ডার সৃষ্টি করেছে।

কিয়েল ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপীয় দেশগুলোও ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কিনেছে অথবা রাশিয়ার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় দাতা দেশ, বিশেষত সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে। তবে সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনকে ১৩৮ বিলিয়ন ডলার সরাসরি সহায়তা দিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ১২০ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি।

সামরিক সহায়তার ক্ষেত্রে ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ২ বিলিয়ন ডলার কম দিলেও, আর্থিক ও মানবিক সহায়তায় ২১ বিলিয়ন ডলার বেশি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর, জার্মানি ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় দাতা। তবে অর্থনীতির আকারের তুলনায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো, পাশাপাশি নেদারল্যান্ডস, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে।

২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে সম্মিলিতভাবে ইউক্রেনকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যা একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সহায়তার পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে বলে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) এবং প্রতিরক্ষা দপ্তর প্রত্যেকের নিজস্ব পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর জেনারেল) রয়েছে, যারা মার্কিন সহায়তার অপব্যবহার বা দুর্নীতি তদন্ত করে। এ ছাড়া, ইউক্রেন সংক্রান্ত একটি আন্তঃসংস্থা পর্যবেক্ষণ দল গঠন করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত কংগ্রেসে প্রতিবেদন দাখিল করে।

পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও ইউএসএআইডির পরিদর্শকদের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেন এখনো ‘বহু স্তরে সরকারি দুর্নীতির’ সমস্যার সঙ্গে লড়াই করছে। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো অর্থের কোনো অংশ আত্মসাৎ হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ এখনো মেলেনি। তারা ইউক্রেনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে প্রতিরক্ষা কেনাকাটার সংস্কারসহ বিভিন্ন দুর্নীতি দমন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার হিসাব নিয়ে পার্থক্যের মূল কারণ হলো, কী কী উপাদান এই মোট হিসাবের অন্তর্ভুক্ত তা নিয়ে ভিন্নতা। কিছু হিসাবে প্রতিশ্রুত সহায়তা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যতক্ষণ না তা চূড়ান্তভাবে বরাদ্দ হয়। কিছু হিসাবে এমন ব্যয় ধরা হয় না, যা সরাসরি ইউক্রেনের সহায়তায় ব্যবহৃত হয়নি। আবার কিছু হিসাব সামরিক সহায়তার ওপর গুরুত্ব দিলেও আর্থিক ও মানবিক সহায়তাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না।

ট্রাম্প যে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের হিসাব দিয়েছেন, তার উৎস নিশ্চিত করা যায়নি। কিয়েল ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সমস্ত দাতা দেশ মিলিয়ে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ করা মোট ২৮০ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও অনেক বেশি। জেলেনস্কির মতে, এখন পর্যন্ত যুদ্ধের মোট খরচ ৩২০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ইউক্রেন নিজেই ১২০ বিলিয়ন ডলার বহন করেছে, আর বাকি অর্থ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছে।
 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়