সোহেল তাজ এর প্রতি খোলা চিঠি প্রিয় সোহেল তাজ
সোহেল তাজ এর প্রতি খোলা চিঠি
প্রিয় সোহেল তাজ
আমার এক কবি বন্ধু যমুনা টিভিতে দেয়া আপনার একটি সাক্ষাৎকার আমাকে পাঠিয়েছেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার দেয়া বক্তব্যটি তার নিশ্চয়ই খুব মনে ধরেছে তাই আমার সাথেও শেয়ার করেছেন। আমি খুব মনোযোগ সহকারে আপনার বক্তব্যটি শুনলাম। খুবই মানবিক কথাবার্তা। মনেহলো খুব সচেতনতার সাথে আপনি রাজনীতি পরিহার করেছেন আপনার বক্তব্যে। কিন্তু, শুরুতে আপনার পরিচয় দিতে গিয়ে আপনি আপনার বাবা মুজিবনগর সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ এবং মাতা শ্রদ্ধেয়া বেগম জোহরা তাজউদ্দীন এঁর কথা উল্লেখ করেছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক এবং এই পরিচয়ই আপনাকে আরো দশজনের থেকে বাড়তি সুযোগ করে দেয় দেশের সংকটে কথা বলবার জন্যে।
আপনার প্রতি আমার একটা বিশেষ ক্রেইজ (craze) ছিলো, কেনো ছিলো যদি জানতে চান তবে বিপদে পড়ে যাব এ'জন্য যে তা আপনার জন্যে না, তা ছিলো আপনার সেই কালোত্তীর্ণ মা-বাবার জন্যে। রাজনীতিই তাঁদেরকে সৃষ্টি করেছিলো এবং রাজনীতির কারনেই আপনার বাবাকে প্রাণ দিতে হয়েছে আর মা'কে অকালে বৈধব্য বরণ করতে হয়েছে, শুধু তা-ই নয় বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন সেই পাশবিকতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবার জন্যে। আজ আপনাকে উদ্দেশ্য করে আমি যে খোলা চিঠি লিখছি সে অধিকারও আমাকে রাজনীতিই দিয়েছে। আমার মনে আছে, '৭৫ পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের আহবায়ক হিসেবে যখনই বেগম জোহরা তাজউদ্দীন সিলেট এসেছেন, তাঁর প্রত্যেকটি সভায় আমি উপস্থিত থেকেছি। বক্তৃতায় দাঁড়িয়ে তিনি যখন বলতেন "আজ রক্তমাখা আচল নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি" তখন উপস্থিত সকলের মতো আমিও কেঁদেছি। সুতরাং রাজনীতির বাইরে যাবার সুযোগ আপনার-আমার কারো নেই!
এই পরিচয়ের বাইরেও আপনি সংসদ সদস্য ছিলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো সেনসিটিভ (sensitive) জায়গায় মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। দেশ এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ষড়যন্ত্রের গভীরতা আমার মতো প্রান্তিক রাজনৈতিক কর্মীর চেয়ে আপনার শতগুণ অধিক জানা থাকার কথা। সুতরাং রাজনীতি বিবর্জিত আপনার বক্তব্য আমাকে চিন্তিত করেছে! আপনার বক্তব্যে সঙ্গত কারণেই ছোট ছোট বাচ্চাদের মৃত্যুর কথা উল্লেখ ছিলো, কিন্তু আপনার বক্তব্যে স্থান পায়নি ছাদ থেকে ফেলে দেয়া কিংবা হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা আওয়ামী লীগ কর্মীর মৃতদেহ কিংবা ওভার ব্রিজ থেকে ঝুলিয়ে রাখা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাশ! ধরে নিলাম কোটা আন্দোলন স্রেফ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ছিলো এবং সরকারও পুলিশ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে এই আন্দোলনকে কনটেইন (contain) করার চেষ্টা করছিলো কিন্তু যখন থেকে এই আন্দোলন মারমুখী রূপ ধারণ করতে শুরু করলো, সরকারও বর্ডার গার্ড, র্যাব মোতায়েন করলো এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে বলতে লাগলো যে দেশদ্রোহী গোষ্ঠী আন্দোলনের নেতৃত্ব হাইজ্যাক করে তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পায়তারা করছে কিংবা সর্বশেষ যখন সেনাবাহিনী মোতায়েন করলো তখন ঐ আন্দোলন সমন্বয়কারীদের কী করা উচিৎ ছিলো! তাদের তো এটা না বুঝার কোনো কারণ নেই যে, যেহেতু এই আন্দোলন তার ঈপ্সিত লক্ষ্য থেকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, সরকারও নাশকতা বন্ধে পিছপা হবেনা, পরিনতিতে সকল পক্ষেই প্রাণনাশ হবে সুতরাং এখানে তাদের একটা দায়িত্ব আছে, যা তারা পালন করতে নিদারুণ ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আপনার বক্তব্যে তারও কোনো উল্লেখ ছিলোনা। আপনি যদি বলতেন যে এখানে আমাদের একটা সামষ্টিক ব্যর্থতা ছিলো তাহলে বুঝা যেতো যে আপনি একটা নির্মোহ অবস্থান থেকে কথাগুলো বলছেন!
প্রিয় সোহেল তাজ, আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি মনেকরি আপনার এই statement সরকারকে একতরফাভাবে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে! এই সরকার হেরে গেলে যারা জয়ী হবে তারা আপনার পিতাসহ জাতিরপিতার হন্তারক, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের সকল অর্জনের হন্তারক, যে স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখার জন্য আপনার পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের সরকার থেকে অব্যহতি পাবার পরও টু শব্দটি করেননি, নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও মোস্তাকের সাথে আপোষ করেননি সেই স্বপ্নের হন্তারক।
আমার প্রজন্ম সেই হন্তারকদের বিরুদ্ধে কৈশোর থেকে লড়ে যাচ্ছে, হয়তো আমৃত্যু তা-ই করতে হবে কিন্তু পিছু হটবে না। আপনি যখন বিদেশের মাটিতে বড়ো হচ্ছিলেন, এই প্রজন্মই হন্তারকদের বিচার চাইতে গিয়ে লাশ হয়েছে কিংবা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে সুতরাং খুব 'মহান' হবার সুযোগ আমাকের কই! যে স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমরা রাজপথ বেছে নিয়েছি, স্বপ্নপূরণ পর্যন্ত আমরা রাজপথেই থাকবো - এই অঙ্গীকার আপনাকে জানিয়ে রাখলাম। এ-ও জানিয়ে রাখছি যে হয়তো কোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপনিও এই দলের নেতৃত্বে আসতে পারেন কিংবা নতুন কোনো রাজনৈতিক দলও করতে পারেন কিন্তু আমার আজকের এই বক্তব্যের জন্য আমি কুণ্ঠিত হবোনা।
আপনি, আপনার মতো করে ভালো থাকবেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি।
ইতি
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এক প্রান্তিক কর্মী
মোহাম্মদ হরমুজ আলী।